মন খারাপ বেশি দিন থাকে না। আসে, চলেও যায়। অতএব সাধারণ মন খারাপ ও ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেসন এক নয়। ডিপ্রেসন বাড়লে একসময় রোগীর দেহ আর সঙ্গ দেয় না। শরীরের দখল নেয় বিপুল ক্লান্তি। রোগী ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হতে থাকেন পরিবারের বাকি সদস্যদের থেকে। সামাজিক দায়িত্ব পালন ও কর্মক্ষেত্রে কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে দেখা দেয় পাহাড়প্রমাণ অনীহা। দীর্ঘ বিষাদ আচ্ছন্ন করে রাখে মস্তিষ্ককে। আচ্ছন্ন ভাব থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারেন না।
অবসাদ বুঝবেন কীভাবে?
বিষণ্ণতা যদি দুই সপ্তাহের বেশি সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়, দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকে, আনন্দের তিলমাত্র অনুভূতিও চলে যায়, বুঝতে হবে সাধারণ মন খারাপ পরিণত হয়েছে অবসাদে।
গভীর অবসাদে মানুষ আর নিজের মনের কথা কাউকে বলতে পারে না। চারিদিকে অদৃশ্য দেওয়াল তুলে দেন।
নিজের, নিজের ভবিষ্যৎ এবং অন্যের সম্পর্কে বিরামহীন নেতিবাচক চিন্তা করে যান।
পড়াশোনা, টিভি দেখা, মোবাইল ঘাঁটা—একটানা মনোযোগ দিয়ে কিছু করা অসম্ভব হয়ে যায়।
কেউ খাওয়া কমান। কেউ বাড়িয়ে দেন। কারও ঘুম কমে। কারও ঘুমের সময়কাল বাড়ে।
শরীরে ও মনে অপার ক্লান্তি বোধ করেন।
কিছুতে আনন্দ পান না। কমে যায় শারীরিক ঘনিষ্ঠতার ইচ্ছে।
মেয়েদের ঝুঁকি বেশি
ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ঝুঁকি বেশি। কারণ পুরুষের তুলনায় হর্মোনের স্রোতের সঙ্গে মহিলাদের লড়াই করতে হয় অনেক বেশি। বয়ঃসন্ধিকালে যখন একসঙ্গে হর্মোনের ঢেউ আসে, দেহে মনে ঝড়ের মতো পরিবর্তন হতে থাকে, শরীরের এই পরিবর্তনের সঙ্গে সব মেয়ে সমানভাবে যুঝে নিতে পারে না। ঘন ঘন মন মেজাজের পরিবর্তন হয়। সেখান থেকে আসতে পারে ডিপ্রেসন। যেমন, প্রসবের অব্যবহিত পর হর্মোনের ভারসাম্যহীনতা ডেকে আনে পিপিডি বা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেসন।
মেনোপজের সময় হর্মোনের নিরাপত্তা চলে যাওয়ায় মহিলাদের মনে অসম্ভব চাপ পড়ে। সেখান থেকেও ডিপ্রেসন আসা অসম্ভব নয়।
শিশু ও বয়স্কদের ডিপ্রেসন
বাচ্চাদেরও ডিপ্রেসন দেখা দিতে পারে। ছোটদের ডিপ্রেসনের লক্ষণ হল— মেজাজ খিটখিটে হওয়া। রেজাল্ট খারাপ হতেও দেখা যায়।
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধূমপান ও মদ্যপানের আসক্তি বেড়ে যায়।
বয়স্ক মানুষের আত্মীয়রা ধীরে ধীরে দূরে চলে যায়। কথা বলার লোকের অভাব হয়। শারীরিক অসুস্থতাও থাকে। তাই ডিপ্রেসন আসা অসম্ভব নয়। অনেক সময় ডিমেনশিয়া ও ডিপ্রেসন মিলেমিশেও থাকে। লক্ষণগুলি হল— কথা বলা কমিয়ে দেওয়া।
সুগার ও ডিপ্রেসন
হাইপোথাইরয়েড, ডায়াবেটিসের আক্রান্ত রোগীদের ডিপ্রেসনে ভোগার ঝুঁকি কিন্তু বেশি থাকে।
মস্তিষ্কের অন্দরে কী হয়?
হিপ্পোক্যাম্পাসের ভূমিকা: ব্রেনে হিপ্পোক্যাম্পাস নামে একটি অংশ থেকে আজীবন নতুন নিউরনের জোগান মেলে। এই কারণেই সারাজীবন ধরে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করে মানুষ। ধারাবাহিক স্ট্রেসের কারণে অতিরিক্ত কর্টিজল সেই হিপ্পোক্যাম্পাসের ক্ষতি করতে পারে। নতুন কিছু শেখার ইচ্ছে চলে যায়।
নতুন গবেষণা: রোগীদের পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, তাঁদের মস্তিষ্কে প্রদাহজনিত কারণে ব্রেনের নিউরনগুলি ছোট হয়ে এসেছে। হ্রাস পেয়েছে উদ্দীপনা বয়ে নিয়ে যাওয়ায় দায়ী নিউরোট্রান্সমিটার। কমেছে সেরেটোনিন, নরএপিনেফ্রিন, ডোপামিনের ছোটাছুটি।
দুশ্চিন্তা: স্ট্রেস বেশি হলে ব্রেনের হাইপোথ্যালামাসের নির্দেশে অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ড থেকে বেশি পরিমাণে কর্টিজল ক্ষরণ হয় যা ব্রেনের পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক।
কী কী ক্ষতি?
বাচ্চাদের পঠনপাঠনে মারাত্মক ক্ষতি হয়।
তরুণ বয়সে ডিপ্রেসন আত্মহত্যা বা আত্মহত্যার চেষ্টার কারণ হতে পারে।
পরিণত বয়সে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, নেশায় আসক্তি, কর্মক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া ইত্যাদি সমস্যা তৈরি করে।
বয়স্করা আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।
ডিপ্রেসন কাটানোর চিকিৎসা
কগনাইটিভ বিহেভেরিয়াল থেরাপি: ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার পথে অস্বাস্থ্যকর বিশ্বাসও বহন করেন অনেকে। যেমন তাঁকে ভালোবাসা যায় না, তিনি কোনও কাজেরই উপযুক্ত নন, তিনি প্রবলভাবে অসহায় ইত্যাদি। এই ধরনের নেতিবাচক বিশ্বাস ডিপ্রেসনের জন্ম দিতে পারে। কাউন্সেলর বা থেরাপিস্ট রোগীর সঙ্গে কথা বলে এমন বিষবৃক্ষের মতো বিশ্বাসগুলি ধীরে ধীরে মন থেকে উপড়ে ফেলেন। সুস্থ বিশ্বাস প্রোথিত করেন। ডিপ্রেসনের প্রাথমিক ও মাঝারি পর্যায়ের রোগীদের এই ধরনের চিকিৎসা করিয়ে সুফল মেলে।
অ্যাকসেপট্যান্স অ্যান্ড কমিটমেন্ট থেরাপি (এসিটি): অনেকক্ষেত্রে ছোট ছোট মন খারাপ দীর্ঘদিন ধরে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর সম্মিলিত ফসল হয় ডিপ্রেসন। এসিটি বলছে, ছোট ছোট মন খারাপগুলোকে স্বীকার করতে শিখুন। সবসময় আনন্দের পিছনে ছুটতে যাবেন না। তাতে মন খারাপ বাড়বে। বরং চুপ করে জীবনকে উপভোগ করুন। কাজ করে যান। আনন্দই একসময় আপনাকে স্পর্শ করে যাবে। এই দর্শন শেখায়—হর্ষের পাশাপাশি বিষাদও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাতে ক্ষণিকের দুঃখ সহজে মেনে নেওয়া যায়।
ওষুধ: অবসাদের চিকিৎসায় ওষুধ খুব বড় ভূমিকা পালন করে। অবসাদের লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসক রোগীকে বেশ কিছু ওধুধ দেন। ওষুধগুলি মস্তিষ্কে সেরেটোনিন, নরএপিনেফ্রিন, ডোপামিনের মতো নিউরো ট্রান্সমিটারের মাত্রা বাড়ায়।
ডিপ্রেসন ও এক্সারসাইজ—
শরীরচর্চা করলে দেহে ডোপামিনের মাত্রা বাড়ে, যা আনন্দদায়ক অনুভূতি বাড়াতে সাহায্য করে। নতুন কাজ করায় উৎসাহ তৈরি হয়।
আমাদের দায়িত্ব
অবসাদগ্রস্ত মানুষের কাছে থাকা, তার সঙ্গে কথা বলা, তার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলাই রোগীর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাজ। অবশ্য সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতিতে সবসময় হয়তো শারীরিকভাবে রোগীর কাছে পৌঁছনো সম্ভব নয়। তবে চেষ্টা করতে হবে রোগীকে একা না ছাড়ার। নিয়মিত ভিডিও কল, ফোনে যোগাযোগ করে ইতিবাচক কথা বলে যেতে হবে। অবসাদের চোরাবালি থেকে একটা প্রাণকে রক্ষা করার এই একমাত্র উপায়।
সংগৃহীত
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any link in the comment Box