ক্যান্সার কী ?
বিশ্বের সমস্ত প্রাণীর শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের মাধ্যমে তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মারা যায়। এই পুরনো কোষগুলোর জায়গায় নতুন কোষ এসে জায়গা করে নেয়। সাধারনভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। সাধারনভাবে বলতে গেলে যখন এই কোষগুলো কোনও কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। একেই টিউমার বলে। এই টিউমার বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যান্সার বলে। বিস্তারিতভাবে বলতে গেলে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে বিভাজনক্ষম হয়ে বৃদ্ধি পাওয়া কলাকে নিওপ্লাসিয়া (টিউমার) বলে, এবং সেই রকম ক্রিয়া যুক্ত কোষকে নিওপ্লাস্টিক কোষ বলে। নিওপ্লাস্টিক কোষ আশেপাশের কলাকে ভেদ করতে না পারলে তাকে বলে নিরীহ বা বিনাইন টিউমার। বিনাইন টিউমর ক্যান্সার নয়। নিওপ্লাসিয়া কলা ভেদক ক্ষমতা সম্পন্ন হলে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যান্সার, এবং তার অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনক্ষম ভেদক ক্ষমতাযুক্ত কোষগুলিকে ক্যান্সার কোষ বলে। অনেক ক্যান্সার প্রথমে বিনাইন টিউমার হিসাবে শুরু হয়, পরে তার মধ্যেকার কিছু কোষ পরিবর্তিত (ট্রান্সফর্মেসন) হয়ে ম্যালিগন্যান্ট (অর্থাৎ ভেদক ক্ষমতাযুক্ত) হয়ে যায়। তবে বিনাইন টিউমার ক্যান্সারে পরিবর্তিত হবেই তার কোন স্থিরতা নেই। কিছু বিনাইন টিউমার সদৃশ ব্যাধি আছে যাতে ক্যান্সার হওয়া অবশ্যম্ভাবী - এদের প্রি-ক্যান্সার বলে। নামে বিনাইন অর্থাৎ নিরীহ হলেও বিনাইন টিউমারও চাপ দিয়ে আশেপাশের কলার ক্ষতি করতে পারে। মেটাস্ট্যাসিস হলো ক্যান্সারের একটি পর্যায়, যাতে ক্যান্সার কোষগুলি অন্যান্য কলাকে ভেদ করে ও রক্ত, লসিকাতন্ত্র (Lymphatic System) ইত্যাদির মাধ্যমে দূরবর্তী কলায় ছড়িয়ে যায়। স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর যদি আমরা ধুমপান করি তাহলে অন্যথায় এটি নাও হতে পারে।
ক্যান্সারের কারণ-ঠিক কি কারণে ক্যান্সার হয় সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। তবে সাধারণ কিছু কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে।
বয়স
সাধারণত বয়স যত বাড়তে থাকে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও তত বাড়তে থাকে, কারণ এ সময়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এক হিসেবে দেখা যায় যত মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাদের শতকরা ৭০ ভাগেরই বয়স ৬০ বছরের ওপর।
খাবার এবং জীবনযাপনের ধারা
খাবার এবং জীবনযাপনের ধারার সাথে ক্যান্সারের গভীর সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে গবেষকরা। যেমন, ধুমপান বা মদ্যপানের সাথে ফুসফুস, মুখ ও কণ্ঠনালীর এবং যকৃৎ বা লিভারের ক্যান্সারের যোগাযোগ রয়েছে। তেমনই ভাবে পান-সুপারি, জর্দা, মাংস, অতিরিক্ত লবণ, চিনি ইত্যাদি খাবারের সাথেও ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে। যারা সাধারণত শারীরিক পরিশ্রম কম করে তাদের মধ্যেও ক্যান্সারের প্রবণতাটা বেশি।
পারিবারিক ইতিহাস
ক্যান্সারের সাথে জিনগত সম্পর্ক রয়েছে বলেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই কারণে পরিবারের কারো যদি ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা থাকে তাহলে অন্যদেরও ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকখানি বেড়ে যায়।
ক্যান্সারের সাধারণ কিছু লক্ষণ
মানবদেহে যে সকল স্থানে ক্যান্সার ধরা পড়েছে তা হল প্রস্টেট গ্রন্থি, স্তন, জরায়ু, অগ্ন্যাশয়, রক্তের ক্যান্সার, চামড়ায় ক্যান্সার ইত্যাদি। একেক ক্যান্সারের জন্য একেক ধরনের লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে।
- খুব ক্লান্ত বোধ করা
- [ক্ষুধা] কমে যাওয়া
- শরীরের যে কোনজায়গায় চাকা বা দলা দেখা দেয়া
- দীর্ঘস্থায়ী কাশি বা গলা ভাঙা
- মলত্যাগে পরিবর্তন আসা (ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা মলের সাথে রক্ত যাওয়া)
- জ্বর, রাতে ঠান্ডা লাগা বা ঘেমে যাওয়া
- অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমা
- অস্বাভাবিক রক্তপাত হওয়া
- ত্বকের পরিবর্তন দেখা যাওয়া
- মানসিক অস্বস্তি
বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন।
আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা বলছে, দেশটিতে এবছর দেড় লাখের বেশি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে।
কিন্তু বাংলাদেশে ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা যা আছে, তা একদিকে অপ্রতুল এবং অন্যদিকে দীর্ঘ মেয়াদে অনেক ব্যয়বহুল। আক্রান্তদের অনেকে বলেছেন, চিকিৎসা ব্যয় সামলাতে গিয়ে জমিজমা বিক্রি করে পরিবারগুলো নিঃস্ব হয়ে পড়ছে।
ঢাকায় জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট এর ৩০০ শয্যার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ রোগীই নিম্ন আয়ের পরিবারের নারী এবং পুরুষ।
সেখানে রোগীদের কয়েকজন বলেছেন, বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় সরকারি এই হাসপাতালে খরচ কিছুটা কম। কিন্তু লম্বা সময় ধরে সেটাও সামাল দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন নারী বলেছেন, সময়মতো হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা পাওয়ার জন্যও তাদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
"আমি ঢাকার বাইরে থেকে আসি। কিন্তু এখানে সময়মতো সিরিয়াল পাই না। আসলে বলে ১০দিন পরে আসেন। আবার কয়েকদিন পর আসতে বলে। আমি সময়মতো চিকিৎসা পাই না। টাকাও অনেক খরচ হয়। সেটা যোগাড় করাও আমাদের মতো নিম্ন আয়ের মানুষের সমস্যা, খুব সমস্যা।"
মধ্যবিত্তরাও বিপদে, কিন্তু তারা কাউকে বলতে পারেন না
জামালপুরের একজন গৃহিনী ইসমত আরা নাজমা ক্যান্সারে আক্রান্ত হন নয় বছর আগে।
তাঁর শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ার পর প্রথম পর্যায়ে অপারেশন করতেই পাঁচ লাখ টাকার বেশি ব্যয় হয়।
এরপর ধাপে ধাপে চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে।
আক্রান্ত হওয়ার দুই বছরের মাথায় তাঁর স্বামী স্ট্রোক করে মারা যান। তখন স্কুল শিক্ষার্থী দুই ছেলে মেয়ের পড়াশুনা এবং অন্যদিকে নিজের ব্যয়বহুল চিকিৎসা সামলাতে গিয়ে বেশ কষ্ট হয় মধ্যবিত্ত পরিবারের ইসমত আরা নাজমার।
"তখন আমার স্বামী ছিল। চাকরি করতো। দুইটা ছেলে মেয়ে লেখা-পড়ার মধ্যে ছিল। ঐ সময় ক্যান্সার ধরা পড়লো। তারপরে অপারেশন হওয়ার পরে তো আমার স্বামী নিজেই স্ট্রোক করে মারা গেলো। শুধু টেনশন করে উনি মারা গেলেন। যাই হোক, আমার জন্য একটু জুলুমই হচ্ছে, তারপরও চিকিৎসা না করলে তো হয় না।"
"চেক আপ করাতে যাই। অনেক টেস্ট দেয়, তাতে অনেক টাকা লাগে। মাঝখানে একটা টেস্ট দিয়েছিলো, তাতে ৬৫ হাজার টাকা লাগে। এত টাকা লাগে, আমার জন্য জুলুম হয়ে যায়। ধরেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর আমার আব্বা বেঁচে ছিলেন। তিনি এবং আমার ভাইরা সাহায্য করেছেন। কত আর তাদের কাছ থেকে নেই। তো এখন ঐ জমিজমার মধ্যে হাত দেই।"
পুরোপুরি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় হরমোন থেরাপি থেকে শুরু করে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি এবং অনেক ঔষধের প্রয়োজন হয়।
এর প্রতিটি ধাপেই বড় অংকের অর্থ গুনতে হয়।
'চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য অনেকে দারিদ্র সীমার নীচে নেমে যাচ্ছে'
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিজামউদ্দিন আহমেদ একজন চিকিৎসক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে উল্লেখ করেন, চিকিৎসা ব্যয় পরিবারগুলোকেই পঙ্গু করে দিচ্ছে।
"একটা ক্যান্সার ইনস্টিটিউট আছে। কেউ কেউ ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরেও যান। কিন্তু সেটা দিয়ে কি আমরা বলতে পারি, জাতীয়ভাবে আমরা সমর্থ, মোটেও না।"
তিনি আরও বলেছেন, "প্রতিবছর অনেক মানুষ চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য দরিদ্র সীমার নীচে নেমে যাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অনেক মানুষই ধারণা না থাকায়, এই সেবা নিতে গিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন, নিজে মারা যাচ্ছেন, তার পরিবারকেও মেরে রেখে যাচ্ছেন। এই নিষ্ঠুর সত্যটা আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না বুঝবো, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্যান্সার শব্দটা নিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি হবেই।"
ক্যান্সারের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটা আছে?
ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যে ঢাকায় একটি মাত্র বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতাল এবং বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে হাতেগোনা কয়েকটি।
ঢাকার বাইরে মাত্র দু'টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সীমিত আকারে চিকিৎসা দেয়া হয়।
এই রোগের চিকিৎসা সেবা মূলত ঢাকা কেন্দ্রিক।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার বলছিলেন, ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সে কারণে রোগীদের সেবা পেতেও সময় লেগে যাচ্ছে।
"যা করছি আমরা ঢাকায় করছি। কিন্তু ১ লাখ ৫০ হাজার রোগী যদি নতুন করে আক্রান্ত হয়, এর যদি তিন ভাগের একভাগ রোগীও ডায়াগনসিস হয়, তাহলে যে ক'টা হাসপাতাল আছে, তাতে ৫০ হাজার রোগীর চিকিৎসা ঢাকা শহর কি করে দেবে?"
"লম্বা সময় লেগে যাচ্ছে। কেমোথেরাপি দিতে এক সপ্তাহ থেকে এক মাস এবং রেডিও থেরাপির সিরিয়াল পেতে চার পাঁচ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যাচ্ছে। অপারেশনেই এরকম সময় লাগছে। ফলে ঢাকার বাইরে অন্তত বিভাগীয় শহরে এই চিকিৎসা গড়ে তুলতে না পারলে মানুষের সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়।"
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরও সংকট রয়েছে
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটের কারণে বিশেষায়িত হাসপাতাল সেভাবে গড়ে উঠছে না বলেও বিশ্লেষকরা বলছেন।
স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও স্বীকার করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটের কথা।
কিন্তু এ ব্যাপারে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোনো উদ্যোগ নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবেরা খাতুন নারীদের ক্যান্সার নিয়ে কাজ করেন।
তিনি বলছিলেন, একটি হাসপাতালেই ক্যান্সারের পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার ব্যবস্থা এখনও করা যায়নি। ফলে রোগীকে চিকিৎসার বিভিন্ন পর্যায়ে হাসপাতাল পাল্টাতে হয়।
"বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা খুবই কম। শুধু বিশেষজ্ঞ হলেই তো হবে না। হাসপাতালে সুবিধা দরকার। সরকারি পর্যায়ে হাসপাতালে সে রকম সুবিধা আছে। কেমোথেরাপিটা ভালই হচ্ছে। কিন্তু রেডিওথেরাপির ব্যাপারে ভীষণ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। যেখানে ১২৬টা রেডিও থেরাপি সেন্টার থাকার কথা, সেখানে হাতে গোনা কয়েকটা আছে। আট দশটাও হবে না।"
সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই কেন?
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারে ১ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ।
গত বছর ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২২ হাজার।
আন্তর্জাতিক সংস্থাটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে এই পরিসংখ্যান দিয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো পরিসংখ্যান নেই। এর কোনো উদ্যোগ কখনও নেয়া হয়নি।
হাবিবুল্লাহ তালুকদার মনে করেন, বাংলাদেশের নিজেদের করা বাস্তবসম্মত কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় চিকিৎসা সেবার পরিকল্পনা করাও সম্ভব হচ্ছে না।
"২০০৯ সালে ক্যান্সার প্রতিরোধে একটা নীতিমালা করা হয়েছিল যেটা আর আপডেট করা হয়নি। সেই নীতিমালা অনুযায়ীও যে সব হচ্ছে, সেটা বলা যায় না। এরজন্য সবার আগে দরকার আমাদের নিজস্ব একটা পরিসংখ্যান। রোগীর সংখ্যা কত..কি ধরণের ক্যান্সার বেশি হচ্ছে, এগুলো যদি না জানতে পারি, তাহলে কিভাবে আমরা পরিকল্পনা নেবো।"