সত্য ঘটনা অবলম্বনে স্বামী স্ত্রীর গল্প । আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা। আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে কথা বলবো।
আমার স্ত্রীর নাম- সুরাইয়া
আমি আমার স্ত্রীর সাথে প্রায় তিন বছর সংসার করেছি। সংসার জীবনে ঝগড়া লাগাটা সাভাবিক, এর কিছু রাগ অভিমান থেকে আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।
আমার ছোট্ট মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছি, অনেক কান্না করেছিলো মেয়েটা। মেয়েটার বয়স তখন দেড় বছর। একটু আকটু কথা বলতে শিখেছিলো।
আমি সুরাইয়া'কে যে দিন ডিভোর্স ্দেই সে দিন আমার একটুও কষ্ট হয়নি, পরে অনেক কেদেছিলাম।
যখন ডিভোর্সের কাগজে সাক্ষর করছিলাম, তখন সুরাইয়া আমাকে বলেছিলো, "আমাদের মেয়েটার কথা একবার ভেবে দেখো। আমি চলে গেলে, মেয়েটা মা পাবে কোথায়। আমার মতো কেউ তাকে ভালবাসবে না"
আমি সে দিন হাসি দিয়ে বলেছিলাম ! মেয়েটাকে নিয়ে আমি দিব্বি ভালো থাকবো। সে কোনদিনও তোমার নামটাও জানতে চাইবে না।
সেই দিনই আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। আমাদের বিয়ের কাবিন করা ছিলো ১লাখ টাকা, কাবিন টাকা সুরাইয়াকে দিতে হবে। আমি কিছু টাকা জমিয়ে ছিলাম একটু জমি কিনবো বলে। আমার সেই টাকা থেকে সুরাইয়াকে কাবিনের টাকা পরিশোধ করলাম, তা দিয়ে সুরাইয়ার সাথে ডিভোর্সের বাকি কাজটা শেষ হলো।
আদলতের বিচারক মেয়েটাকে সুরাইয়ার কাছেই রাখতে বলেছিল।
কিন্তু সুরাইয়া সে দিন বলেছিলো, আমাদের ডিভোর্স হয়েই গেলে। তার মেয়ে দিয়ে আমি কি করবো ! আমার প্রয়োজন নাই। মেয়ে ওর কাছেই থাকুক।
সুরাইয়ার এই সব কথা বলে এটাই বুঝাতে চাইছে। মেয়ে নিবে, যদি তাকে নিয়ে থাকি। আমার মেয়ে ওর লাগবে না।
সব কিছুর পরও সেদিন ডিভোর্স হয়ে গেল। বাড়ি ফেরার পথে, পার্কে গিয়ে বসলাম, সেই দিন অনেক কান্না করেছিলাম। অনেকে আমাকে, বলেছিলো মেয়েটার মা কোথায় মারা গেছে নাকি? আপনি এত কান্না করছেন কেন? সেই দিন আমি তেমন কিছু বলতে পারি নাই, মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখর পানি ফেলেই যাচ্ছি !
পার্কে মেয়েটা কান্না করতে করতে কখন যে কোলো ঘুমিয়ে গিয়েছে বুঝতে পারি নাই। অনেক ভাবলাম তখন, আমিই দোষী নাকি? দুই বছর ভালবাসার পর বিয়ে করেছিলাম।তার পরিণতি এই হলো। আমি একটা ভালো চাকুরীও করি। অনেক ভালবাসার পর বিয়ে।
সুরাইয়ার সাথে ডিভোর্স হবার কারনটা বলি।
জীবনটা অনেক সুখের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো।
আমার সেই দিনের কথা আজও মনে আছে, বিয়ের প্রায় দুই বছর পর, একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরেছি সুরাইয়া আমাকে একটা সুংবাদ দিয়েছিল যে আমাদের সন্তান হবে।
বাবা হওয়ার আনন্দ যে কতটা মধুর, যে প্রথম বাবা হওয়ার খবর শুনে সে বুঝে।
কথা শুনে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।আগেও অনেক কেয়ার নিতাম কিন্তু বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকে সুরাইয়াকে একটু বেশি যত্ন করতাম।আমার মাও সুরাইয়ারঅনেক খেয়াল রাখত।
আমার বাবা অনেক অগেই মারা যায়। বাবা মারা যাওয়ার পর, মা আমাকে ও বড় ভাইকে অনেক কষ্টে বড় করেছে।
বাবার রেখে যাওয়া টাকা থেকে ব্যাংক আমাদের মাসিক কিছু মুনাফা দিতো যা পরিমান ছিল তিন হাজার টাকা। কিছু ধানের জমি ছিলো তা থেকে আমাদের চালের অভাবটা দূর হত।আমাদের সংসারে সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে এল।এর মধ্যে আমরা আরো একটা ভালো চাকরী হোয়ে গেল, তখন মাকে সঙ্গে নিয়ে শহরে চলে আসলাম।
মেয়ে হওয়ার পরই, একটা বিষয় খেয়াল করলাম, সুরাইয়া কেমন জানি হয়ে গিয়েছিলো। মায়ের সাথে প্রায় খারাপ আচরণ করতে শুরু করলো, অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখতাম মায়ের সাথে এটা ওটা নিয়ে লেগেই থাকতো।
আমাকে কিছু বলতো না দুজনই। আমিও জানতে চাইতাম না। তাদের বুঝ অবুঝ ওরাই বুঝবে।
বেশ কিছুদিন চলে গেল, একদিন সুরাইয়া আমাকে বলে, "আমি তোমায় মায়ের সাথে আর থাকতে পারবো না। ওনাকে গ্রামে পাঠিয়ে দাও "
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি বললাম , "আমার মা থাকলে কি সমস্যা? "
সুরাইয়ার জবাব ছিলো এমন, " আমাকে নিয়ে এই বাসায় থাকতে চাইলে মা'কে গ্রামে পাঠিয়ে দাও, আর মা এই বাসায় থাকলে আমাকে আলাদা বাসা নিয়ে দাও। তবুও তোমার মায়ের সাথে থাকবো না।
তা না পারলে, আমাকে ডিভোর্স দাও। তোমার মায়ের দায়িত্ব তোমার একার না, ভাইও আছে "
"তোমার ভাই যদি তোমার মাকে না দেখে আমি কেন একা দেখবো? সবার মা সবার কাছেই দামি "
উত্তরটা এমন ছিলো, "তোমার মা'কে কিছু করলে আমার মা'কে এই বাসায় আনবো। আমার মা'কে তোমার পালতে হবে। " তোমার মাকে আলাদা রাখার কথা বলতে গেলে তুমি রাগ করো। তাহলে আমার মায়ের সাথে কেন এত অভিযোগ? "
সুরাইয়া বললো, "তোমার স্বীদ্ধান্ত কি করবা? মা'কে আলাদা করবা নাকি আমাকে? নাকি আমাকে ডিভোর্স দিবা?"
আমি সেই দিন মুহূর্তে স্বীদ্ধান্ত নিলাম, আর বললাম, "মায়ের সাথে থাকতে না পারলে। তোমাকে আর রাখতে চাই না। তাহলে আমাদের আলাদা থাকাই ভালো।
সেও রাজি হয়ে গেল। কিছুদিন পরই সুরাইয়ার সাথে ডিভোর্স হয়ে গেল।মাও চেয়েছিলো গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি চলে যেতে।
সুরাইয়ার বাবার বাসা ছিল কুমিল্লায়। এখানে চাকুরীর সুবাদে তার সাথে পরিচয় আর পরে প্রেম। বিয়ে করে এখানেই থাকা।আমার ফ্লাটে আমার মা থাকবে। এমন স্ত্রী থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। সেইদিন ডিভোর্স দিয়ে বাসায় ফিরলে, মা বললো রাগ করে এইসব করা ঠিক হয়নি বাবা। মা আমাদের ছোট বেলা থেকেই অনেক আদর যত্ন করতো।আমার মেয়েটাকে দেখা শুনা করতো। আমার বড় ভাই গ্রামের বাড়িতে চাষাবাদ করে, আর ছোট একটা মুদি দোকান চালায়। আমি দোকানটা দিয়ে দিয়েছি।
বড় ভাইয়ের সংসার চালাতে বেশি কষ্ট হতো। তাই মা'কে আমিই রাখি। মাসে মাসে কিছু টাকা দিতে হয় বড় ভাইকে। ভাই যদিও মাকে নিয়ে থাকতে চাইতো, আমি বললাম, শহরে আমি একা। তাই মা আমার সাথে থাকুক।
সবাই অনেক মিলেমিশে থাকি।সুখ নামের পাখিটা ধরা দিতে না দিতে হঠাৎ সংসারে অশান্তি শুরু হয়ে গেল, অশান্তি শুরু হতে না হতে সুরাইয়া আমাদের থেকে চলে গেল। আমাদের সংসারে তিন জন সদস্য তাও অশান্তি। আমার বাবা চলে যাবার পর মা অনেক কষ্ট করে বড় করলো, তাকে দূর করার চেয়ে ওই নারী থেকে দূরে থাকা ভালো। দেখতে দেখতে অনেক দিন কেটে গেল। মার পিরাপিরিতে একটা বিয়ে করতে হল। মা বেশ কিছু দিন হল মেয়ে দেখছে কারন মায়ের শরীল ভালো যাচ্ছে না তাই। মা আমার মেয়েটাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করতো। এর মধ্যে আমার অফিসে চাকুরীর খোঁজে একটা মেয়ে এসেছিলো।মেয়েটা এতিম ছিল,তার কথা বাতা শুনে অনেক ভাল আর ভদ্র মনে হল, সব কিছু দেখে সেই সেইদিন ভালো লেগেছিলো।
মেয়েটার সব ঠিকানা জেনে মা'কে দিয়ে তার সাথে কথা বলে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম। আমারসব কিছু বুঝিয়ে বলেছিলাম।
বিয়ে করে নিলাম সানজিদাকে।মেয়েটার নাম বলা হয়নি তার নাম ছিল সানজিদা। বিয়ের পর জানলাম সে হাফেজা, হিফজ্ শেষ হওয়ার পর, মাদ্রাসা পড়াশোনা করেছে। তারপর কলেজে ভর্তি হয়ে, নিজের খরচ নিজে চালাতো। পড়াশোনা শেষ করে, নিজের একটা ঠিকানা হয়তো বানাতে চেয়েছিলো।
সুরাইয়াকে ডিভোর্স দেওয়ার সাড়ে তিনবছর পর সানজিদাকে বিয়ে করলাম। এতিম হওয়ায়, আমার মা'কে মায়ের মতোই ভালবাসতো। আমার মেয়েটা যেনো তারই মেয়ে এমন ভাবে দেখাশোনা করতো।
মেয়েটাও বড় হয়ে সানজিদাকেই মা বলে ডাকেত। বিয়ের ৩বছর পর সানজিদা মা হল। আমাদের সুখের নীড়ে আসে, একটা ছেলে সন্তান। দু-ছেলেমেয়ে নিয়ে আমাদের সংসার ভালোই চললো।
কিভাবে ২০টা বছর কেটে গেলো জানি না! আমার মেয়ের যখন ৭বছর বয়স তখন আমার মা , দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো।
আমার মেয়েটাকে নিজের মায়ের মতো ভালবাসে সানজিদা। আজকে এই মা আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে নতুন ঘরে। আজকে আমাদের মেয়ের বিয়ে।
এই ২০বছরে সে আজও জানে না, তার মায়ের নাম সুরাইয়া ; সানজিদা যে তাকে জন্ম দেয়নি। সে তা যানে না।
সে এটাই জানে সানজিদা তার মা। সানজিদা কোনদিন বুঝতেই দেইনি, আর কখনো পরের মেয়ে ভাবেনি।
কিছু দিন পরে মেয়েটা বিদায় নিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি। সানজিদা এতটাই ভালবাসা দিয়ে ছিলো, আমাদের সংসার যেনো স্বর্গ হয়েছিলো। সানজিদা আমাকে উল্টো বলেছিলো, যেনো কখনো মেয়েকে এটা না বলে, তার সৎ মেয়ে।
আল্লাহ হয়তো মায়ের জন্য, ত্যাগ করাটা পছন্দ করেছিলো।
তাই রহমত করে এমন স্ত্রী আমাকে দিয়েছিলো। এটাই সত্য, ত্যাগ করলে ভালো কিছু হবেই ইনশাআল্লাহ।
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any link in the comment Box