দেশে করোনা সংক্রমনের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। শীতের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে করোনার সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কাও জানিয়েছেন তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সংক্রমনের দ্বিতীয় ঢেউ যত বড়ই হোক তা মোকাবিলার সক্ষমতা রয়েছে সরকারের।
শুরুর পর করোনা সংক্রমণের হার কমে বা স্তিমিত হয়ে পুনরায় ঊর্ধ্বমুখী হলে তাকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা হয়। ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে এ বছরের শুরুর দিকে থেকে করোনার অতিমারি শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে অধিকাংশ দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। বেশ কিছু দিন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকার পর অনেক দেশে আবার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দ্বিতীয় দফার এই সংক্রমণের নাম দিয়েছেন ‘দ্বিতীয় ঢেউ’। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়াতে পৃথিবীতে আবার আতঙ্ক শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী প্রথম শনাক্ত হয় ৮ মার্চে। এরপর শনাক্তের হার ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। এক সময় সেটা ২৩ শতাংশের উঠে যায়। এ অবস্থা থাকে কয়েক সপ্তাহ। তারপর ধীরে ধীরে সংক্রমণ কমতে থাকে। তবে, অন্য অনেক দেশের থেকে বাংলাদেশে করোনার রেখাচিত্র ভিন্ন। বেশির ভাগ দেশে করোনার গতিপথ অনেকটা ইংরেজি বর্ণমালার উল্টো ‘ভি’ অক্ষরের মতো। অর্থাৎ শুরু হওয়ার পর থেকে সংক্রমণের হার বাড়তে থাকে এবং এক সময় চূড়ায় পৌঁছে যায়। তারপর আবার কমে আসতে থাকে। অধিকাংশ দেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার কমবেশি তিনমাসের মধ্যে সংক্রমণরেখা চূড়ায় পৌঁছে যায়। এরপর সংক্রমণ কমতে থাকে। ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণরেখার নিচে চলে আসে। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা অনেকটা উপবৃত্তাকার পথ অনুসরণ করছে। অর্থাৎ করোনা সংক্রমণের রেখাচিত্রে বাংলাদেশে কোনো দৃশ্যমান চূড়া নেই। সংক্রমণ শুরুর পর আট মাসের মতো হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সংক্রমণের ধারা এখনো চলমান। কিন্তু কিছুটা কমে আসার পর আবার শনাক্তের সংখ্যা বাড়ায় একে দ্বিতীয় ঢেউ বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।
৮ মার্চ দেশে প্রথম তিন জন করোনা রোগী শনাক্তের ১০ দিন পর ১৮ মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কথা জানায় কথা জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর।
এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার। দেশে ৩০ জুন সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছে ৬৪ জনের। এরপর ৫০ থেকে ৬০-এর কোঠায়। ফলে জুলায় মাসে মৃত্যু হয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৬৪ জনের। আগস্টের পর কিছুটা কমতে থাকে মৃত্যুর হার। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেও একেবারে কম ছিল করোনায় মৃত্যু। কিন্ত শীত বাড়ার সাথে সাথে তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আবারো বাড়তে থাকে শনাক্ত ও মৃত্যুর হার। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়ায় হাসপাতালগুলোতেও ভিড় বাড়ছে রোগীদের।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মো. আল আমিন বলেন, ১০ নভেম্বরের আগে করোনা ইউনিটে ফাঁকা ছিলে অনেক বেড। কিন্ত এখন চিত্র পুরো উল্টো।চিকিৎসকেরা বলছেন, সংক্রমণ রোধে মাস্ক পরাসহ সচেতন হতে হবে নিজেকে। পাশাপাশি জনসমাগম আবারো সীমিত করার দাবি তাদের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশের ১১৭ টি ল্যাবে প্রতিদিন ৫০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা সক্ষমতা রয়েছ সেই সাথে মৃত্যু ঝুঁকি কমাতে প্রস্তত আছে প্রায় ১২ হাজার বেড। করোনার সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই বলেও জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসে দৈনিক টেস্টের সংখ্যা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে সবচেয়ে বেশি টেস্ট করা হয়েছিল ১২ নভেম্বর। সেদিন ১৭ হাজারের বেশি টেস্ট করা হয়েছিল। আর সর্বনিম্ন ৭ নভেম্বর ১১ হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ দৈনিক টেস্টের সংখ্যা এখনো গড়ে ১৫ হাজারের বেশি নয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, প্রথম ধাপে পর্যাপ্ত মাত্রায় পরীক্ষা করা হয়নি বলে অনেকে বাদ পরে গেছেন। যার কারণে সংক্রমণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। আর তারাই সংক্রমণের মাত্রা অনেক বেশি হারে ছড়িয়েছে। সেটি এখন বন্ধ করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে অ্যান্টিজেন-ভিত্তিক র্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার করে নমুনা টেস্ট করাতে হবে।
তিনি আরো বলেন, যাতে আধা ঘণ্টার মধ্যে টেস্টের রেজাল্ট দিয়ে রোগীকে বলা যায় যে তার কভিড রয়েছে কিনা এবং তাকে আইসোলেশনে যেতে হবে কিনা।
কভিড-১৯ কিন্তু শুরু হয়েছিল গত শীতেই, চীনে শীতকালটা তাণ্ডব চালিয়েছিল এই ভাইরাস। তারপর এ বছরের শুরু দিকে ইউরোপ ও আমেরিকাও এর জটিল রূপ দেখেছে। এ ছাড়া গবেষকেরা বলেন, যেকোনো ভাইরাস শীতল ও শুষ্ক আবহাওয়া পছন্দ করে। শীতে মানুষের বদ্ধ ঘরে থাকার প্রবণতা বাড়ে, ফলে অ্যারোসল ছড়ায় বেশি। শীতে দুনিয়াজুড়ে বয়স্ক ও শিশুদের ফুসফুস সংক্রমণজনিত মৃত্যুহারও সবচেয়ে বেশি থাকে। এ বছর বড়সংখ্যক নবজাতক শিশু লকডাউন ও অতিমারির কারণে যথাসময়ে সব টিকা শেষ করতে পারেনি। সারা পৃথিবীতেই এ অবস্থা। তাই এবার শীতে অনেক বেশিসংখ্যক শিশু নিউমোনিয়া, হুপিং কফ, হাম, মাম্পস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হবে বলে এখনই ধারণা করা হচ্ছে। তাই সামনের শীত নিয়ে কিছুটা আশঙ্কা আছে বৈকি। কারণ এখনো করোনা সংক্রমণ না নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, না এর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসটি অনেক দ্রুতগতিতে রূপ পরিবর্তন করছে। বিশ্বে করোনা ভাইরাসের রূপান্তরের হার ৭ দশমিক ২৩ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস রূপান্তরের হার ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরির এক গবেষক দল এই তথ্য জানিয়েছে।
0 comments:
Post a Comment
Please do not enter any link in the comment Box